রোহিঙ্গা আগমনের ৩ বছর

প্রতিবেদক : এমএন/ এমএস
প্রকাশিত: ২৫ আগস্ট, ২০২০ ৯:৫১ পূর্বাহ্ণ

মিয়ানমারের রাখাইনের একটি মসজিদে ইমামতি করতেন মাওলানা ফজলুল করিম (৪৫)। প্রতিদিনের মতো তিনি সকালে মসজিদের বারান্দায় ছেলেমেয়েদের কোরআন শিক্ষা দিচ্ছিলেন। ঠিক সে সময় মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও সশস্ত্র রাখাইন সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণে দিগ্বিক ছুটাছুটি করে পালানোর সময় তিনিও পার্শ্ববর্তী ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে পড়েন। ঘণ্টাখানেক পরে বেরিয়ে এসে দেখেন তার মাদ্রাসায় আগুন জ্বলছে। সাত-আট জন ছেলেমেয়ের রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে আছে। বিভীষিকাময় এ দৃশ্য দেখে তিনি আর একমুহূর্তও দেরি করেননি। পাঁচ দিনের মাথায় অর্থাত্ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট তিনি আনজুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে কুতুপালং এসে আশ্রয় নেন। কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে বসবাসরত মাওলানা ফজলুল করিম জানান, এ সময় তার মতো হাজার হাজার মানুষ এদেশে চলে আসার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। কিন্তু মাওলানা করিমদের শরণার্থীর জীবনের অবসান হয়নি তিন বছরেও।

তিন বছর শরণার্থী জীবনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে হাকিমপাড়া ক্যাম্পের মাঝি নবী হোছন জানান, যদিও বাংলাদেশ সরকার তাদের সাহায্য-সহযোগিতা, থাকা-খাওয়া, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করেছে তাতে তারা খুশি। তবে তারা সুখী না। জানতে চাইলে বলেন, মাতৃভূমির জন্য বারবার মন কাঁদে। সরকার প্রত্যাবাসনের জন্য বেশ তত্পর হলেও বাস্তবায়ন না হওয়ায় চিন্তিত আছেন। তবে দেশে ফিরে যেতে পারবে—এ আশায় দিন গুনছেন।

ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ৮ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী আরো ৪ লাখ রোহিঙ্গা এদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তত্পরতা ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চুক্তি স্বাক্ষর করলেও বিভিন্ন তালবাহনা শুরু করে কালক্ষেপণ করলে প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় উখিয়া টেকনাফে বিভিন্ন লোকালয়ে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় মানুষের মনোভাব ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে রোহিঙ্গা মাঝিদের অভিমত।

বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম শরণার্থী শিবির উখিয়ার কুতুপালংয়ে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। এখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে গড়ে উঠেছে শত শত দোকানপাট ও হাটবাজার। সকাল-সন্ধ্যা এসব হাটবাজারে জমজমাট বেচাকেনা হচ্ছে। এমনকি রাখাইনের কয়েকটি নামকরা বাজার যেমন বলি বাজার ও শাহাব বাজারের আদলে গড়ে ওঠা বাজারগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন রোহিঙ্গারা। এখানে স্বর্ণের দোকান থেকে শুরু করে কসমেটিকস, কাপড়, ওষুধসহ যাবতীয় নিত্যপণ্য হাতবাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে। ক্যাম্প ঘিরে নিজেদের আলাদা সমাজ গড়ে তুলেছেন রোহিঙ্গারা। ৩৪টি ক্যাম্পের প্রতিটিতে তাদের নিজস্ব নেতৃত্বের কাঠামো রয়েছে।

ক্যাম্প ইনচার্জের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ক্যাম্পে নির্বাচিত একজন চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রতি ব্লকে রয়েছেন একজন করে নেতা, যাকে মাঝি বলে ডাকেন রোহিঙ্গারা। সোমবার বিকালে ঐ আশ্রয়শিবির ঘুরে রোহিঙ্গাদের আড্ডা-গল্প আর বিকিকিনিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। একটি দোকানে রোহিঙ্গা ভাষায় গানও পরিবেশন করছিলেন বেশকিছু রোহিঙ্গা। কুতুপালং ও লম্বাশিয়া দুই ক্যাম্পের দুই জায়গায় বল নিয়ে খেলতে দেখা যায় রোহিঙ্গা তরুণদের।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসাবে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ৫ লাখ ৯৮ হাজার জন শিশু বসবাস করছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ হাজারের জন্ম হয়েছে ক্যাম্পেই। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন বলছে, তাদের মধ্যে তিন থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশু প্রায় ৩ লাখ। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত চার থেকে ১৪ বছর বয়সি ৩ লাখ ৯০ হাজার শিশু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছে। প্রায় ২৫ হাজার শিশুর কোনো ধরনের শিক্ষার সুযোগ হয়নি। অন্যদিকে, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সি শিশুদের ৯৭ শতাংশই শিক্ষার বাইরে থাকছে জানিয়ে ইউনিসেফ বলছে, অপরাধ, শিশুশ্রম, মানব পাচার ও বাল্যবিয়ের মতো ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে তারা।

কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ জালাল আহমদ বলেন, আজ ২৫ আগস্ট যাতে ক্যাম্পে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা রোহিঙ্গারা ঘটাতে না পারে সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, এ দিন ক্যাম্প থেকে কোনো রোহিঙ্গা বাইরে যেতে পারবে না, চার-পাঁচ জন রোহিঙ্গা জমায়েত হতে পারবে না। এছাড়া সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ফেস্টুন বহন করা সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে ৪৯ সদস্যবিশিষ্ট সাতটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটির সদস্যরা ক্যাম্প পুলিশের সঙ্গে ক্যাম্পে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করার কথা রয়েছে। তিনি বলেন, বিগত দিনের মতো ক্যাম্পে কোনোরূপ কর্মসূচি থাকছে না বলে ঐ চেয়ারম্যান জানিয়েছেন। কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জ খলিলুর রহমান জানান, ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা আগমনের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। তাই রোহিঙ্গারা যাতে এদিনে ক্যাম্পে কোনোরূপ কর্মসূচি দিতে না পারে সে জন্য ক্যাম্প প্রশাসনকে তত্পর রাখা হয়েছে। দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ক্যাম্প মাঝিদের। এর ব্যতিক্রম ঘটলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন