একজন জান্নাতি ব্যক্তির পরিচয় ও গুণাগুণ

প্রতিবেদক : এমএন/ এমএস
প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর, ২০২০ ১০:৪৪ অপরাহ্ণ

আনাস বিন মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, আমরা একদিন রাসূল (সা.) এর সঙ্গে মসজিদে বসা ছিলাম। তিনি বললেন, এখনই এই গিরিপথ হতে তোমাদের নিকট একজন জান্নাতি ব্যক্তি আগমন করবে।

অতঃপর একজন আনসার সাহাবি আগমন করলেন, যার দাড়ি দিয়ে ওজুর পানি ঝরছিল এবং তিনি তার বাম হাতে জুতা জোড়া ঝুলিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি সালাম দিলেন। যখন পরের দিন আসল তখন রাসূল (সা) পূর্বের দিনের ন্যায় বক্তব্য পেশ করলেন।

ইতোমধ্যে লোকটি প্রথম বারের মতো আগমন করলেন। তৃতীয় দিনের আগমন ঘটলে রাসূল (সা.) পূর্বের মতো মন্তব্য পেশ করলেন।

তখন ওই লোকটি আগের অবস্থায় আগমন করলেন। অতঃপর নবী করিম (সা.) যখন মসজিদ থেকে প্রস্থান করলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আছ (রা.) ওই ব্যক্তির পিছু নিলেন। তিনি বলেন, আমি আমার পিতার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে কসম করে বলেছি যে, আমি তিন দিন তার নিকটে প্রবেশ করব না। আপনি যদি আমাকে আপনার নিকটে আশ্রয় দেন এবং এভাবে তিন দিন চলে যায় তাহলে আমি সেটিই করব।

তিনি বললেন, ঠিক আছে। আনাস (রা.) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর বর্ণনা করেন, তিনি তার সঙ্গে তিন রাত্রি অতিবাহিত করলেন। কিন্তু তিনি তাকে রাতের কোনো সময় জাগ্রত হয়ে ইবাদত করতে দেখলেন না। তবে তার যখনই ঘুম ভাঙ্গছিল বা বিছানায় পার্শ্ব পরিবর্তন করছিলেন, তখনই আল্লাহর জিকির করছিলেন এবং তাকবির পাঠ করছিলেন।

(রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি রাতে ঘুম ভাঙ্গার সময় বলবে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহূ লা শারিকা লাহূ লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর, আল-হামদু লিল্লা-হি ওয়া সুবহা-নাল্লা-হি, ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়া আল্লাহু আকবার, ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ’)

অর্থ: ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। তাঁরই রাজত্ব, তাঁরই প্রশংসা এবং তিনি হলেন সর্বশক্তিমান। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, আল্লাহ পবিত্র, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই, আল্লাহ মহান, নেই কোনো ক্ষমতা, নেই কোনো শক্তি আল্লাহ ছাড়া’।

অতঃপর বলে, রাবিবগ ফিরলী। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও বা দোয়া করে তাহলে তার দোয়া কবুল করা হবে। যদি সে ওজু করে সালাত আদায় করে তবে তার সালাত কবুল করা হবে’। (বুখারি হা/১১৫৪; মিশকাত হা/১২১৩)

তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে নিম্ন আকাশে অবতরণ করেন এবং ফজর পর্যন্ত বান্দাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, কে আছো আমাকে আহ্বানকারী, আমি তার আহ্বানে সাড়া দেব। কে আছ আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দান করব। কে আছ আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করব’। এভাবে বলতে থাকেন যতক্ষণ না ফজরের আলো স্পষ্ট হয়’। (বুখারি হা/১১১৫; মুসলিম হা/৭৫৮; মিশকাত হা/১২২৩)

অবশেষে ফজরের আজান হলে সালাতের জন্য জাগ্রত হলেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) বলেন, আমি তাকে কেবল ভালো কিছু বলতে শুনতাম। যখন তিন রাত অতিবাহিত হয়ে গেল এবং আমি তার আমলসমূহকে প্রায় তুচ্ছ জ্ঞান করছিলাম, তখন তাকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা! আমি ও আমার পিতার মাঝে কোনো রাগারাগি বা বিচ্ছেদ ছিল না। কিন্তু আমি রাসূল (সা.)-কে তিনবার বলতে শুনেছি যে, এখন তোমাদের নিকট একজন জান্নাতি ব্যক্তি আগমন করবে।

এরপর তিনবারই আপনি আগমন করলেন। তাই আমি ইচ্ছা করলাম যে, আপনার নিকটে অবস্থান করে আপনার আমল পর্যবেক্ষণ করব এবং আপনাকে অনুকরণ করব। কিন্তু আমি আপনাকে তেমন বেশি আমল করতে দেখলাম না। সুতরাং কোন আমল আপনাকে রাসূল (সা.) এর বাণীর মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে।

তিনি বললেন, তুমি যা দেখেছ তাই আমল করি। যখন আমি তার নিকট হতে চলে যাচ্ছিলাম তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, তুমি আমাকে যা করতে দেখেছ আমি এর বেশি কিছু করি না। তবে আমার হৃদয়ে মুসলমানদের কারো প্রতি বিদ্বেষ অনুভব করি না এবং আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে কাউকে কিছু দান করলে আমি কারো প্রতি হিংসা পোষণ করি না। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) বলন, এই গুণই আপনাকে এই মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। আর এটিই আমরা করতে সক্ষম হই না। (আহমাদ হা/১২৭২০; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২০৫৫৯)

ইরাক্বী, হায়ছামী ও শু‘আইব আরনাঊত বলেন, এর সনদ সহিহ’ (আহমাদ হা/১২৭২০; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৩০৪৮; তাখরীজুল ইহইয়া হা/৩১৪৯)। শায়খ আলবানী হাদিসটিকে প্রথমে সহিহ (যঈফাহ ১/২৫, ভুমিকা দ্রঃ) বললেও পরে এর সনদ দোষমুক্ত নয় বলে মত পোষণ করেছেন’ (যঈফ তারগীব হা/১৭২৮, তারাজু‘আতুল আলবানী হা/৪৮)

শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহ.) বলেন, এ থেকে বুঝা যায় তিনি সব প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত ও নিরাপদ ছিলেন। এজন্য আল্লাহ তায়ালা আনসারি সাহাবিদের প্রশংসা করে বলেছেন,

‘আর মুহাজিরদেরকে যা প্রদান করা হয়েছে, তার জন্য এরা তাদের অন্তরে কোনো ঈর্ষা অনুভব করে না এবং নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ওপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। যাদের মনের কার্পণ্য থেকে রক্ষা করা হয়েছে, তারাই সফলকাম’। (সূরা: হাশর ৫৯/১০) অর্থাৎ তাদের মুহাজির ভাইদেরকে যা দান করা হয়েছে, তা থেকে। (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১০/১১৮-১১৯)

রাসূল (সা) বলেন, ‘তোমরা পরস্পরের ছিদ্রান্বেষণ করো না, হিংসা করো না, বিদ্বেষ করো না, চক্রান্ত করো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে সবাই ভাই ভাই হয়ে যাও’। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত হা/৫০২৮)

রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয় এবং এমন সব বান্দাকে মাফ করে দেয়া হয়, যারা আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করে না। তবে ওই ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হয় না, যার মধ্যে ও তার কোনো ভাইয়ের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ বিদ্যমান। তখন ফেরেশতাগণকে বলা হয়, এদেরকে পরস্পরে মীমাংসা করার জন্য সুযোগ দাও’। (মুসলিম হা/২৫৬৫; মিশকাত হা/৫০২৯)

অতএব, আসুন! হিংসা-বিদ্বেষ ত্যাগ করে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করি। আল্লাহ আমাদের জান্নাতি হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন